সূরা ফাতিহার ফজিলত

 


🌸 সূরা আল-ফাতিহার ফজিলত, ব্যাখ্যা ও শিক্ষা

সূরা ফাতিহার পরিচিতি

সূরা আল-ফাতিহা (سورة الفاتحة) কুরআনুল কারিমের প্রথম সূরা। এটি সাতটি আয়াত বিশিষ্ট একটি মহান সূরা, যা “উম্মুল কিতাব” (কিতাবের জননী), “আস-সাব’উল মছানী” (বারবার পাঠিত সাত আয়াত), “আশ-শিফা” (আরোগ্য) এবং “আর-রুকইয়া” (রোগ নিরাময়ের দোয়া) নামেও পরিচিত।

“ফাতিহা” শব্দটি এসেছে আরবি “فتح” (ফাতহা) ধাতু থেকে, যার অর্থ উন্মোচন করা, শুরু করা, সূচনা করা। যেহেতু কুরআনুল কারিমের সূচনা এই সূরার মাধ্যমে হয়েছে, তাই এর নাম হয়েছে সূরা আল-ফাতিহা — অর্থাৎ “সূচনা সূরা”।

এই সূরা মক্কায় নাজিল হয়েছে অধিকাংশ আলেমের মতে। তবে কিছু মুফাসসির বলেন, এটি মদিনায়ও পুনরায় নাজিল হয়। ফলে অনেকে একে মক্কী-মাদানী উভয় সূরা বলে থাকেন।


সূরা আল-ফাতিহার আরবি আয়াত, অনুবাদ ও তাফসির

بسم الله الرحمن الرحيم

অনুবাদ: শুরু করছি আল্লাহর নামে, যিনি পরম দয়ালু, অতিশয় দয়াময়।

তাফসির:
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর নাম নিয়ে প্রতিটি কাজ শুরু করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। “বিসমিল্লাহ” মানে — “আমি আল্লাহর নামে শুরু করছি”।
আল্লাহর দুটি বিশেষ গুণ এখানে এসেছে —

  • আর-রহমান: যিনি সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া করেন।

  • আর-রহিম: যিনি মুমিনদের প্রতি বিশেষ দয়া বর্ষণ করেন।

রাসূল ﷺ বলেছেন —

“যে ব্যক্তি কোনো কাজ ‘বিসমিল্লাহ’ না বলে শুরু করে, তার কাজ বরকতহীন হয়ে যায়।”
(ইবন মাজাহ, হাদীস: ৩৮৪৬)


الحمد لله رب العالمين

অনুবাদ: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সমগ্র জাহানের প্রতিপালক।

তাফসির:
এখানে “আলহামদু লিল্লাহ” অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই জন্য।
“রব্বুল ‘আলামীন” — তিনি সমস্ত জগতের সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক ও পরিচালক।
এই আয়াত আমাদের শেখায়, সব প্রশংসা ও কৃতিত্ব একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য।

রাসূল ﷺ বলেন —

“আল্লাহ বলেন: যখন বান্দা বলে ‘আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামিন’, তখন আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল।’”
(সহীহ মুসলিম)


الرحمن الرحيم

অনুবাদ: যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

তাফসির:
এই দুটি গুণ আবারও উল্লেখ করা হয়েছে — কারণ আল্লাহর রহমতই পুরো সৃষ্টিকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। “আর-রহমান” সাধারণ দয়া, আর “আর-রহিম” বিশেষ দয়া।


مالك يوم الدين

অনুবাদ: বিচার দিনের মালিক।

তাফসির:
আল্লাহ তায়ালা একমাত্র সেই সত্তা, যিনি কিয়ামতের দিন বিচার করবেন।
এখানে “মালিক” শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়েছে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী।
এই আয়াত আমাদের মনে ভয় সৃষ্টি করে — একদিন আমাদের সমস্ত কর্মের হিসাব দিতে হবে।


إياك نعبد وإياك نستعين

অনুবাদ: আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

তাফসির:
এটি সূরা ফাতিহার মূল কেন্দ্রবিন্দু।
এখানে বান্দা ও রবের সম্পর্ক সরাসরি স্থাপিত হয়েছে।
“ইয়্যাকা নাবুদু” — আমরা শুধু তোমার ইবাদত করি।
“ইয়্যাকা নাস্তাঈন” — আমরা শুধু তোমার সাহায্য চাই।

এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছেন তাওহিদের মর্ম
ইবাদত, দোয়া, তওকাল, আশা — সব কেবল আল্লাহর জন্য।


اهدنا الصراط المستقيم

অনুবাদ: আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।

তাফসির:
এখানে বান্দা আল্লাহর কাছে দোয়া করছে — হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সোজা, সত্য পথ দেখাও।
“সিরাতুল মুস্তাকিম” অর্থাৎ এমন পথ যা সোজা, নিরাপদ ও সফলতার দিকে নিয়ে যায় — অর্থাৎ ইসলামের পথ, নবীদের পথ।


صراط الذين أنعمت عليهم غير المغضوب عليهم ولا الضالين

অনুবাদ: সেই পথ, যাদের তুমি অনুগ্রহ করেছ; তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে, এবং যারা পথভ্রষ্ট।

তাফসির:
এখানে তিনটি শ্রেণির উল্লেখ আছে —

  1. যাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়েছে — নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সালেহগণ।

  2. যাদের প্রতি গজব নাযিল হয়েছে — যারা জেনেও অবাধ্য হয়েছে, যেমন ইহুদিরা।

  3. যারা পথভ্রষ্ট — যারা জ্ঞান ছাড়া ভুল পথে চলেছে, যেমন নাসারারা।


সূরা ফাতিহার নাম ও উপাধি

হাদীসে এসেছে সূরা ফাতিহার একাধিক নাম —

  1. আল-ফাতিহা — সূচনা সূরা।

  2. উম্মুল কিতাব — কুরআনের মূল সারাংশ।

  3. আস-সাব’উল মছানী — বারবার পাঠিত সাত আয়াত।

  4. আশ-শিফা — আরোগ্যের সূরা।

  5. আর-রুকইয়া — রোগ নিরাময়ের দোয়া।

রাসূল ﷺ বলেছেন, “সূরা ফাতিহা হচ্ছে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫০০৬)


সূরা ফাতিহার ফজিলত

১️⃣ কুরআনের শ্রেষ্ঠ সূরা

আবু সাঈদ ইবনুল মুআল্লা (রাঃ) বলেন —

“আমি মসজিদে নামাজ পড়ছিলাম, নবী ﷺ আমাকে ডাকলেন। পরে বললেন, ‘আমি তোমাকে এমন এক সূরা শেখাব, যা কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা।’ তারপর তিনি বললেন, ‘এটি হলো সূরা আল-ফাতিহা।’”
(সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫০০৬)


২️⃣ নামাজের প্রতিটি রাকাতে আবশ্যিক

সূরা ফাতিহা ছাড়া নামাজ বৈধ নয়।
রাসূল ﷺ বলেছেন —

“যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা না পড়ে নামাজ পড়ে, তার নামাজ নেই।”
(সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৩৯৫)


৩️⃣ আরোগ্যের দোয়া

সহীহ হাদীসে এসেছে, সাহাবারা একবার এক গ্রামের লোককে সূরা ফাতিহা পড়ে ঝাড়ফুঁক করলে সে সুস্থ হয়ে যায়। নবী ﷺ বলেন —

“তোমরা কীভাবে জানলে যে এটি শিফা?”
(সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫৭৩৬)


৪️⃣ আল্লাহর সাথে বান্দার সরাসরি সম্পর্ক

আল্লাহ বলেন —

“আমি নামাজ (সূরা ফাতিহা) কে আমার ও আমার বান্দার মধ্যে ভাগ করেছি।”
(সহীহ মুসলিম)

অর্থাৎ, বান্দা যখন বলে “আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামিন”, আল্লাহ বলেন, “আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল।”
এভাবে প্রতিটি আয়াতের জবাব আল্লাহ দেন — যা বান্দা ও রবের এক অনন্য সংলাপ।


সূরা ফাতিহার শিক্ষা ও বার্তা

১️⃣ তাওহিদ ও ঈমানের শিক্ষা:
সূরা ফাতিহার প্রতিটি অংশে আল্লাহর একত্ব, তাঁর রহমত ও ক্ষমতার স্বীকৃতি রয়েছে।

২️⃣ ইবাদতের পরিশুদ্ধতা:
“ইয়্যাকা নাবুদু” শেখায় যে ইবাদত শুধু আল্লাহর জন্য হতে হবে।

৩️⃣ দোয়া ও নির্ভরতার শিক্ষা:
“ইয়্যাকা নাস্তাঈন” শেখায় যে সাহায্য শুধুই আল্লাহর কাছে চাইতে হবে।

৪️⃣ হেদায়াতের আবেদন:
“ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম” — বান্দার চিরকালীন দোয়া যেন সঠিক পথে থাকতে পারে।

৫️⃣ সতর্কতা ও আত্মসমালোচনা:
“গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ্দাল্লীন” — গজবপ্রাপ্ত ও পথভ্রষ্টদের পথ থেকে দূরে থাকা।


সূরা ফাতিহা ও আত্মশুদ্ধি

সূরা ফাতিহা শুধু তিলাওয়াতের সূরা নয় — এটি একটি আত্মিক শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির দিকনির্দেশনা।
যে ব্যক্তি প্রতিদিন নামাজে একাগ্র মনে এটি পাঠ করে, তার অন্তরে শান্তি, ভরসা ও আল্লাহর স্মরণ দৃঢ় হয়।

এ সূরা আমাদের শেখায় —

  • কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে,

  • রহমতের আশা রাখতে,

  • বিচার দিনের ভয় মনে রাখতে,

  • আল্লাহর সাহায্যে নির্ভর করতে,

  • ও সর্বদা সঠিক পথের জন্য দোয়া করতে।


সূরা ফাতিহা ও রোগ নিরাময়

হাদীস অনুযায়ী, সূরা ফাতিহা হলো “রুকইয়া” বা দোয়া দ্বারা চিকিৎসার একটি মাধ্যম।
যখন কেউ অসুস্থ হয়, এই সূরা পাঠ করে আল্লাহর কাছে শিফা চাইলে এতে বরকত ও আরোগ্য আসে।

রাসূল ﷺ বলেন —
“সূরা ফাতিহা হলো প্রত্যেক রোগের জন্য শিফা।”
(দারিমি, হাদীস: ৩২৯৮)


সূরা ফাতিহা ও দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব

সূরা ফাতিহা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রেরণা দেয় —

  • কাজ শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করতে।

  • কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে।

  • দুঃসময়ে ‘ইয়্যাকা নাস্তাঈন’ বলে সাহায্য চাইতে।

  • জীবনের সিদ্ধান্তে ‘ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম’ বলে সঠিক পথের দোয়া করতে।


সূরা ফাতিহা: কুরআনের সারসংক্ষেপ

অনেক আলেম বলেছেন, সূরা ফাতিহা হলো পুরো কুরআনের সারমর্ম।
কারণ,

  • কুরআনের উদ্দেশ্য তিনটি বিষয়: আকীদাহ (বিশ্বাস), ইবাদত (কর্ম), ও আচরণ (নৈতিকতা)
    এই তিনটি বিষয়ই সূরা ফাতিহায় বিদ্যমান।


সূরা ফাতিহা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাসমূহ

১️⃣ সব প্রশংসা শুধু আল্লাহর।
২️⃣ আল্লাহই দয়ালু ও করুণাময়।
৩️⃣ কিয়ামতের মালিক আল্লাহ।
৪️⃣ ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য।
৫️⃣ সাহায্য কেবল আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করতে হয়।
৬️⃣ সোজা পথের দোয়া সবসময় করতে হয়।
৭️⃣ পথভ্রষ্টদের পথ থেকে দূরে থাকতে হয়।


উপসংহার

সূরা আল-ফাতিহা একটি ছোট সূরা হলেও এর অর্থ ও শিক্ষা সীমাহীন। এটি কুরআনের মূল সুর, ইসলামের সারাংশ, ঈমান ও তাওহিদের ঘোষণা, আর আল্লাহর রহমত ও হেদায়াতের দোয়া।

যে ব্যক্তি প্রতিদিন নামাজে এই সূরা গভীরভাবে পড়ে, সে শুধু নামাজ পড়ছে না — বরং আল্লাহর সঙ্গে কথা বলছে, নিজের আত্মাকে শুদ্ধ করছে, এবং চিরন্তন মুক্তির পথে হাঁটছে।


🌺 সংক্ষিপ্তভাবে সূরা ফাতিহার ফজিলতের সারাংশ:

বিষয়বর্ণনা
সূরার নামসূরা আল-ফাতিহা
আয়াত সংখ্যা
অবতরণের স্থানমক্কা (অধিকাংশের মতে)
প্রধান বিষয়তাওহিদ, রহমত, বিচার, ইবাদত, দোয়া
ফজিলতকুরআনের শ্রেষ্ঠ সূরা, নামাজে আবশ্যিক, রোগ নিরাময়কারী
হাদীসসহীহ বুখারী ও মুসলিমে একাধিক বর্ণনা

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সূরা ফাতিহার অর্থ অনুধাবন করে আমল করার তাওফিক দান করুন।
آمين يا رب العالمين.

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url