মানুষ জুলুমের বদলা দুনিয়াতেও পাবে

জুলুম সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

ভূমিকা

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আজকের আলোচনার বিষয় জুলুম — অন্যায়, অবিচার।
এ সম্বন্ধে ইসলাম কী বলে, ইসলামে এর শাস্তি কী — এ সম্পর্কে আজকে সংক্ষিপ্ত কিছু বিষয় আপনাদের সামনে তুলে ধরব, ইনশাআল্লাহ।


জুলুমের অর্থ ও বাস্তবতা

অন্যায়ভাবে কারো প্রতি জুলুম করা, কারো প্রতি অবিচার করা, নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখানো, কাউকে দুর্বল পেয়ে তার প্রতি চড়াও হওয়া, অন্যায়ভাবে ঠকিয়ে তার সাথে অবিচার করা — এই সকল কিছুর শাস্তি আখিরাতে তো আছেই, দুনিয়াতেও আল্লাহ তায়ালা এর শাস্তি দিয়ে থাকেন।

আমরা একটু লক্ষ্য করলেই পূর্বের ইতিহাস থেকে বুঝতে পারি যে পৃথিবীতে এমন কোন জালেম নাই, এমন কোন অত্যাচারী নাই, যে অন্যায়ভাবে মানুষের উপর জুলুম করেছে, তাদেরকে কষ্ট দিয়েছে — কিন্তু তার সেই শাস্তি দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাকে দেননি।

আল্লাহ তায়ালা প্রথমে ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না।
আল্লাহ ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না।


ইতিহাসের প্রথম জালেম – কাবিল

যদি বাস্তব উদাহরণ দিতে চাই, তাহলে একদম সৃষ্টির শুরু লগ্ন থেকে দেখি — মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম জালেম ছিলেন হযরত আদম (আ.)-এর পুত্র কাবিল

সে জুলুম করেছিল তার আপন ভাই হাবিলের ওপর।
আল্লাহ তাআলা তার শাস্তি দুনিয়াতে দিয়েছেনই, তাকে অপমানিত করেছেন, তার মুখোশ সকলের সামনে উন্মোচন করেছেন।

যখন পৃথিবীতে মানুষ বসবাস শুরু করে, তখন থেকেই এই ঘটনাটি শিক্ষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আজও আমরা সেই ঘটনাটি শুনে কাবিলের ওপর ধিক্কার জানাই।
এটাই প্রমাণ করে যে আল্লাহ তাআলা জুলুমের বিচার আখিরাতে করবেনই, কিন্তু দুনিয়াতেও কাউকে ছেড়ে দেন না।


ইতিহাসের অন্যান্য জালেমদের পরিণতি

পৃথিবীর ইতিহাসে আরও অনেক জালেম ছিল —
যারা যুগে যুগে অতিবাহিত হয়ে গেছে।

যেমন নমরুদ, যে জুলুম করেছিল।
আবু জাহল, যে মুসলমানদের ও আমাদের নবী (সা.)-এর ওপর জুলুম করেছিল।
এছাড়াও আরও অনেকে, যারা পরাশক্তি ছিল, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অপদস্ত করেছেন, অপমান করেছেন, তাদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন এবং শাস্তি দিয়েছেন।

আল্লাহ বলেন:

إِنَّمَا نُمْلِي لَهُمْ إِنَّ كَيْدِي مَتِينٌ
“আমি তাদের ছাড় দিয়ে রাখি, কিন্তু আমার ধরা খুবই শক্ত।”

যখন আল্লাহ ধরেন, তখন আর বাঁচার কোন উপায় থাকে না।


জুলুমের পরিণতি ও আল্লাহর সাহায্য মজলুমের জন্য

জুলুম এমন একটি অপরাধ, যে কোনো মুসলমান যদি কোনো অমুসলিমের উপরে জুলুম করে,
কোন নামাজি মানুষ যদি কোনো বেনামাজির ওপর জুলুম করে —
তবুও আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ওই মজলুম ব্যক্তির পক্ষেই থাকে।

যদিও সে অমুসলিম বা গুনাহগার হোক,
যদিও সে আল্লাহর ইবাদত না করে —
তারপরও আল্লাহ তাআলা সেই মজলুম ব্যক্তির সাথেই থাকেন।
জুলুমকে আল্লাহ তাআলা কখনোই প্রশ্রয় দেন না।


পশু-পাখির মধ্যেও ন্যায়বিচার

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।
মানুষের প্রয়োজনে আল্লাহ তায়ালা অন্যান্য সব প্রাণী, পাখি, বৃক্ষলতা সৃষ্টি করেছেন।

আল্লাহ বলেন, তিনি জিন ও ইনসান অর্থাৎ মানুষ ও জিনের হিসাব নিবেন।
তবে জুলুমের ব্যাপারে এমনকি পশুদের মধ্যেও বিচার হবে।

যদি কোন পশু আরেক পশুর ওপর অন্যায় করে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন দুনিয়ার সবলকে দুর্বল বানাবেন এবং দুর্বলকে সবল বানাবেন —
যাতে তারা পরস্পরের হিসাব সমান করতে পারে।
এরপর যখন বিচার সম্পন্ন হবে, তখন তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

এটাই পশু-পাখিদের জুলুমের হিসাব।
তাহলে ভাবুন — আল্লাহ যদি প্রাণীদের মধ্যেও ইনসাফ করেন,
তাহলে মানুষ, যাদের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ কত কঠোর হবেন!


আল্লাহর ইনসাফ ও জুলুমের বিরুদ্ধে ঘোষণা

আল্লাহ বলেন:

وَمَا رَبُّكَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ
“তোমার রব বান্দার প্রতি কোনো জুলুম করেন না।”

হাদীস কুদসিতে আল্লাহ বলেন:

إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي
“আমি আমার নিজের প্রতি জুলুমকে হারাম করেছি।”

আল্লাহর ওপর তো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু তিনি নিজেই জুলুম হারাম ঘোষণা করেছেন — আমাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে, জুলুম কত ভয়াবহ ব্যাপার।


দৈনন্দিন জীবনে জুলুমের উদাহরণ

আমরা অনেক সময় অজান্তেই জুলুম করে ফেলি।

যেমন,

  • রাস্তায় কোনো রিকশাওয়ালাকে কষ্ট দিয়ে তার প্রতি কঠোর আচরণ,

  • নিজের অধীনস্থ লোকদের প্রতি জুলুম,

  • বন্ধুদের সাথে থাকলে কথাবার্তায় অহংকার করা,

  • কর্মস্থলে বসের অনুপস্থিতিতে কাজে ফাঁকি দেওয়া।

এগুলো সবই জুলুমের বিভিন্ন রূপ।

যদি আমরা একবার নিজেদের জায়গা থেকে ভাবি —
যাদের আমরা শ্রদ্ধা করি, তারা যদি আমাদের ওপর জুলুম করে, তাহলে কেমন লাগে?
ঠিক তেমনি, যাদের প্রতি আমরা অন্যায় করছি, তাদেরও সেইরকম কষ্ট হয়।


দুনিয়াতে জুলুমের দ্রুত শাস্তি

আল্লাহ তাআলা বলেন, যদি কেউ কারো ওপর চুল পরিমাণও জুলুম করে,
তার বিচার আল্লাহ করবেন — শুধু আখিরাতে নয়, দুনিয়াতেও।

আবু দাউদ শরীফের এক হাদীসে নবী করীম (সা.) বলেন:

“জুলুম এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার মতো গুনাহের শাস্তি
আল্লাহ দুনিয়াতেই ত্বরিত দেন।”

অর্থাৎ, একজন জালেম দুনিয়াতে শান্তিতে হাসতে হাসতে মৃত্যুবরণ করতে পারে না।
তার জীবনে যন্ত্রণাই আসে — কষ্ট, অপমান ও অবমাননার শাস্তি সে ভোগ করেই দুনিয়া ত্যাগ করে।


কিয়ামতের দিনে জুলুমকারীর পরিণতি

নবী করীম (সা.) বলেন:

"اتدرون من المفلس؟"
“তোমরা কি জানো, সবচেয়ে অভাবী কে?”

সাহাবায়ে কেরাম বললেন:

“যার কাছে সম্পদ বা ধন-সম্পদ নেই।”

রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন:

“না, আসল অভাবী হলো সে ব্যক্তি,
যে দুনিয়াতে অনেক নামাজ, রোযা, হজ, কুরআন তেলাওয়াত করেছে,
কিন্তু মানুষের ওপর জুলুম করেছে, অধিকার নষ্ট করেছে, অপমান করেছে।
কিয়ামতের ময়দানে সে তার আমলের পাহাড় নিয়ে আসবে,
কিন্তু যাদের ওপর জুলুম করেছে তারা তার কাছ থেকে তাদের হক আদায় করবে।
তার সওয়াব একে একে তাদের মধ্যে বণ্টিত হবে,
যতক্ষণ না সব শেষ হয়ে যায়।
এরপরও যদি হক বাকি থাকে,
তখন তাদের গুনাহ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে,
এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”


উপসংহার

তাই, প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ,
আজকের এই ছোট্ট আর্টিকেল থেকে যদি আমি আপনাদের কোনো উপকার করে থাকতে পারি, তাহলে আমার জন্য দোয়া করবেন।

আজকের এই সকল বিষয়গুলোর প্রতি একটু আমল করার চেষ্টা করুন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তৌফিক দিন।

لا حول ولا قوة إلا بالله
السلام عليكم ورحمة الله وبركاته

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url